।। এস.এম.মনিরুল ইসলাম মনি ।।
বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার ভয়াল থাবায় দিশেহারা গোটা বিশ্ব। দিকে দিকে মৃত্যুর মিছিল। করোনার ভয়াবহতায় ইতিমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া এই নোবেল করোনা ভাইরাসের তান্ডবে ফান্স, ইটালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন এর মত উন্নত দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে বিশ্ববাজারে তেলের মুল্যের সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়েছে। জরিমানা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে লিকুইড গোন্ড খ্যাত খনিজ জ্বালানী তেল। প্রতি ব্যারেল তেল ক্রয় করে ক্রেতাকে তো কোন মুল্য তো দিতেই হচ্ছে না বরং উল্টো ক্রেতাই পাচ্ছেন ৩৭.৬৩ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিবিদরা করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির সর্বোচ্চ বিপর্যয়ের সতর্কতা দিচ্ছেন।
সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশের কাতারে দাঁড়ানো বাংলাদেশেও ভয়াল থাবার আঘাত হেনেছে মরণঘাতী করোনা। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। গতকাল (বুধবার) দুপুর পর্যন্ত রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) হিসাবমতে বাংলাদেশে এ যাবৎ মোট আক্রান্ত ৩৭৭২ জন, মোট মৃত্যু ১২০ আর সুস্থ হয়েছেন ৯২ জন। আপাত দৃষ্টিতে অন্য দেশের তুলনায় সংখ্যাটা অনেক কম মনে হলেও স্বস্তির কিছু নেই। দিন দিন বাড়ছে নতুন রোগী। এইতো কদিন আগেও আক্রান্তের সংখ্যাটা ছিল শতক এর ঘরে ১ সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে কয়েকগুন।
করোনা মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ, সাধারণ ছুটি (অঘোষিত লকডাউন) চলছে প্রায় ১ মাস হলো। বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখা কলকারখানাগুলো।
লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের প্রায় ৬ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে প্রশাসনের সর্বোস্তরের কর্মকর্তা/ কর্মচারীরা।
করোনায় মুছে গেছে রক্ত কিংবা নাড়ীর বাঁধন। পত্রপত্রিকা বা টিভির মাধ্যমে অনেকেই দেখেছেন বা শুনেছেন করোনা আক্রান্ত মা/বাবাকে নির্জন স্থানে ফেলে গেছে সন্তান। কিংবা করোনায় মারা যাওয়া পিতার লাশ নিতে বা জানাযা দিতে সন্তানের অপারগতা প্রকাশের খবর। এই যখন অবস্থা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যখন ধাবিত হচ্ছে দেশ।
এমন অবস্থাতেও আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ। সংবাদের শিরোনাম হয়েছে জনপ্রতিনিধিদের ত্রানের চাল চুরির ঘটনাগুলো। স্বাস্থকর্মীদের নকল সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের মত ঘটনাও শিরোনাম হয়েছে।
বাংলাদেশ ছোট আয়তনের ঘনবসতির দেশ হিসেবে রয়েছে চরম ঝুকিতে। ইতিমধ্যে ২ শতাধিক স্বাস্থকর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটা বেশী উদ্বেগজনক।
বিভিন্ন মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারনা এমনকি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না জনসমাগম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান সীমিত আকারে চালু রেখে সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ ঘোষনা করেও মিলছে না সুফল।
সেনাবাহিনী তত্বাবধায়নে হাট-বাজারের সময়সূচী সীমিত করে ও খোলা মাঠে হাট-বাজার সরিয়ে নিলেও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না সামাজিক দুরত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। পাবনা জেলার বিভিন্ন হাটবাজারের দৃশ্যগুলো চরম ভীতির জন্ম দেয়। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ মুলত কাজে দিচ্ছে না।
ভরা মৌসুমে বিভিন্ন খাদ্যশস্য পণ্যের ব্যাপক আমদানি হচ্ছে বাজারগুলোতে সেই সাথে থাকছে উপচেপড়া ক্রেতা বিক্রেতার ভীড়। এসময় মানা হচ্ছে না সামাজিক দুরত্বের বিষয়টি। আবার কাঁচাবাজারের সময়সূচি ভোর হতে সকাল ১১ টা পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে জেলা প্রশাসন।
হাটবাজারগুলোতে লোকসমাগম কমাতে এই পদক্ষেপগুলো নিলেও মূলত হিতে বিপরীতই হয়েছে বলে মনে হয়। আসুন দেখা যাক কিভাবে ঘটছে ব্যাপারটি, ধরুন ১০টি গ্রামের কেন্দ্রস্থল একটি হাট/বাজার। প্রতিটি গ্রামের যদি ১ হাজার মানুষ বাজারে আগমন ঘটে তাহলে মোট মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০ হাজার। আগে হাট / বাজার সারাদিন খোলা থাকায় এই দশ হাজার মানুষ ১০/১১ ঘন্টা সময়ে বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প লোক হাটবাজারগুলো তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে আসতো কিন্তু এই সময়টাকে সীমিত করা হয়েছে। সকাল ৬ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত ৪/৫ ঘন্টা সময়ে ওই একই পরিমান অর্থাৎ আমাদের ধরে নেয়া ১০ হাজার মানুষ একযোগে হাট-বাজারগুলো ঢুকছে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাবেচা করতে আর এতে করেই আগের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশী পরিমান লোকসমাগম ঘটছে হাট-বাজারে। সীমিত সময়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে তারাহুরোতে ঠিক থাকছে না সামাজিক দুরত্বের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। হাট-বাজারগুলো হয়ে উঠছে বেপরোয়া। সময়সূচি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও জনসমাগন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। হাট-বাজার সকালে চালু রেখে কি করোনা বিস্তার রোধ হবে? করোনা তো সকালে ঘুমিয়ে থাকে না। তাই বিষয়টি নিয়ে আবারো ভাবতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনা হলো হাট-বাজার কেন্দ্রিক জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কার্যকর উপায় হতে পারে হাট-বাজারগুলোর বিভাজন করা। আপদকালীন সময়ে বড় হাটগুলোকে বিভাজন করে প্রতিটি গ্রামের ফাঁকা মাঠ বা স্কুল কলেজের মাঠে ছোট পরিসরে ছোট ছোট এলাকা ভিত্তিক অস্থায়ী বাজার ব্যবস্থা চালু করা। তবেই হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে হাট-বাজারের বেপরোয়া জনসমাগম।
আমরা যখন জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সচেতন করতে পারছি না তখন এটিই হয়তো হতে পারে মন্দের ভালো উপায়। বেপরোয়া হাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর খেসারত দিতে হতে পারে অনেক বেশী যতটা কল্পনার চাইতেও বেশী। এই এক একটি বেপরোয়া হাট-বাজারগুলোই হতে পারে প্রাণঘাতী মহামারী করোনার এক একটি পারমাণবিক এ্যাটম বোমা।
লেখক-
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক, পাবনাটাইমস।
0 Comments