বার্তাকক্ষঃ
প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর ভেঙে দুই ভাগ হয়ে গেলো ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন
গণফোরাম। বর্ধিত সভার মাধ্যমে গণফোরাম থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক রেজা
কিবরিয়া, কেন্দ্রীয় নেতা মহসীন রশিদ, আহমেদ শফিকুল্লাহ ও মুসতাক আহমদকে
বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া দলটির প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনকে রাখা হবে কি
না সে বিষয়ে আগামী ২৬ ডিসেম্বর নেতাকর্মীরা কাউন্সিলের মাধ্যমে চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত নেবে। বেরিয়ে যাওয়া অংশের নেতৃত্বে দিচ্ছেন দলটির সাবেক সাধারণ
সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ তিন জন নেতা। এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে দলটির
ভাঙন স্পষ্ট হলো। গণফোরামের একাংশের বর্ধিত সভা শেষে শনিবার (২৬
সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করেন গণফোরামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা
মহসিন মন্টু। তিনি বলেন, ‘আগামী ২৬ ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল
অনুষ্ঠিত হবে। কাউন্সিল সম্পন্ন করার জন্য ২০১ সদস্যের প্রস্তুতি কমিটি করা
হয়েছে।’
মোস্তফা মহসিন এই প্রস্তুতি কমিটির প্রধান ও আহ্বায়ক।
জাতীয় প্রেস ক্লা্বের তৃতীয় তলায় আবদুস সালাম হলে তাদের সভার টানানো
ব্যানারে লেখা ছিল ‘অর্থবহ পরিবর্তনের লক্ষ্যে চাই জাতীয় ঐক্য : বর্ধিত
সভা: গণফোরাম’। আজকের সভার মধ্যে দিয়ে গণফোরামার নামের আরেকটি দল গঠন করতে
যাচ্ছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ‘২৬
ডিসেম্বরের কাউন্সিলে উপস্থিত ডেলিগেটদের মতামত নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে
নতুন দলের বিষয়ে।’
ড. কামাল হোসেনের বিষয়ে তাদের কী সিদ্ধান্ত-
জানতে চাইলে মন্টু বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন সংবিধান প্রণেতা। তাকে আমরা
সম্মান করি। আমরা এখনও বিশ্বাস করি, ড. কামাল হোসেন আমাদের সঙ্গে আসবেন।
বির্তকিত লোকদের পরিহার করবেন। মাঠের পোড় খাওয়া লোকদের নিয়ে এগিয়ে যাবেন।
আর তিনি না আসলে তার বহিষ্কারের বিষয়ে আমাদের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেবো।
সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা আসবে। তাদের মতামত সাপেক্ষে তার বিষয়ে আমরা
সিদ্ধান্ত নেবো।’
মোস্তফা মহসিন মন্টু এ সময় দাবি করেন ড. কামাল
হোসেন স্মৃতিবিভ্রমে ভুগছেন। তার কথাবার্তায় এমনটি মনে হয়। ড. কামাল
হোসেনকে একটি অশুভ শক্তি ঘিরে ধরেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গণফোরাম তো
বিএনপির নেতৃত্বধীন ঐক্যফ্রন্টে আছে, আপনারা কি তাহলে ঐক্যফ্রন্ট থেকে
বেরিয়ে যাচ্ছেন- জানতে চাইলে মন্টু বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের বিষয়ে আমরা এখনও
কোনো সিদ্ধান্ত নেবো না। সামনে আমাদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির মিটিং
আছে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেবো।’ মন্টু আরো বলেন, ‘গণফোরামে যারা স্বাধীনতা
বিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী তাদের বহিষ্কার প্রস্তাব তোলা হবে। অতীতে যে
ভুলভ্রান্তি ছিল তা জলাঞ্জলি দিয়ে গণতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের জাতীয় ঐক্য
গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে দেশে বিপর্যয় আসবে।’
ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে
জোট করে একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং জোটে মানবতাবিরোধী অপরাধে
অভিযুক্ত দল জামায়াতের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মন্টু বলেন,
‘ঐক্যফ্রন্টে জামায়াত ছিল না। আর আমি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবো
বলেছিলাম কামাল হোসেনকে। কিন্তু তিনি যেহেতু দলের সভাপতি ছিলেন, সাধারণ
সম্পাদক হিসেবে তার নির্দেশে আমি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কারণ আমি তার আদেশ
অমান্য করতে পারি না সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। আর সেই নির্বাচন কীভাবে আগের
রাতে হয়ে গেছে আমরা সবাই জানেন।’
অর্থবহ পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণফোরাম
জাতীয় ঐক্য চায় বলেও মন্তব্য করেন মন্টু। বর্ধিত সভার ঘোষণাপত্রে ৭ দফা
দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে আছে- মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক
মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা, নির্বাচন
কমিশনের বিধিমালা সংশোধন ও কার্য্করীভাবে প্রয়োগ করা, দুর্নীতিবাজ,
ঋণখেলাপী ও অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত শাস্তির বিধান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের
বিরাজমান সর্বনাশা দলীয়করণ উচ্ছেদ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের
দ্বারা জনস্বার্থে পরিচালনা প্রভৃতি।
আজকের বর্ধিত সভায় গণফোরামের
কত জেলার প্রতিনিধি আছেন- জানতে চাইলে দলটির সাবেক নির্বাহী সভাপতি
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে গণফোরামের ৫২ জেলার ২৮৩ জন
প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন।’ সুব্রত চৌধুরী আরো বলেন, ‘আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ
হই। গণফোরামকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলি, গণজাগরণ সৃষ্টি করে স্বৈরাচার,
দুঃশাসন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’
বর্ধিত
সভায় গণফোরামের সাবেক নির্বাহী সভাপতি আবু সাইয়িদ বলেন, ‘বর্ধিত সভায় আমরা
সিদ্ধান্ত নিয়েছি সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও গণমুখী করার লক্ষ্যে
আগামী ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় কাউন্সিলকে সফল করার
লক্ষ্যে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে আহ্বায়ক করে ২০১
সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ বর্ধিত সভার মূল মঞ্চে ছিলেন সাবেক সাধারণ
সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, সাবেক নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী,
কেন্দ্রীয় নেতা জগলুল হায়দার আফ্রিক, আসাদুজ্জামান, খান সিদ্দিকুর রহমান,
আবদুর রায়হান, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ফজলুল হক সরকার, এম এ মতিন।
প্রসঙ্গত,
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের বর্তমান আহ্বায়ক
কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া বলেন, ২৬
সেপ্টেম্বরে বর্ধিত সভার সঙ্গে গণফোরামের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সেই
অনুযায়ী আজকের বর্ধিত সভায় তারা কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ২৭ বছর আগে
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আদর্শ ও নীতি নিয়ে প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও
যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মোহসীন মন্টুর
নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে গণফোরাম। দীর্ঘ ২৭ বছরে রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি
অর্জন না থাকলেও ড. কামালের নেতৃত্বে গণফোরাম একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই
পরিচিত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রায় তিন দশক পর এসে ভাঙনের মুখোমুখি সেই
দলটি। এরই মধ্যে দলের একাংশ বর্ধিত সভা করেছে।
এর আগে, গত বছরের মে
মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর থেকেই মূলত গণফোরামের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা
দিতে থাকে। এই কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছায় এ বছরের মার্চের শুরুর দিকে। গত ২
মার্চ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশতাক আহমেদের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে
দুই সাংগঠনিক সম্পাদকসহ চার কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এই চার নেতা
হলেন— সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন ও লতিফুল বারী হামিম,
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক খান সিদ্দিকুর রহমান এবং প্রবাসীকল্যাণ সম্পাদক
আব্দুল হাছিব চৌধুরী। পরদিন ৩ মার্চ ওই বহিষ্কৃত চার নেতা বহিষ্কার করেন
দলের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, সহ-সভাপতি মহসীন রশীদ ও সহ-সভাপতি
শফিকউল্লাহ এবং যুগ্ম সাধারণ মোস্তাককে।
পাল্টাপাল্টি এই বহিষ্কারের
পর ৪ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন কেন্দ্রীয়
কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। নিজেকে আহ্বায়ক ও আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক
রেজা কিবরিয়াকে সম্পাদক রেখে ওই বিজ্ঞপ্তিতে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি
ঘোষণা করেন তিনি। পরে ১২ মার্চ পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করেন তিনি।
ওই সময়ও দলের একাংশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অগণতান্ত্রিকভাবে আহ্বায়ক
কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ড. কামাল
হোসেনকে ২ সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেন। পরে অবশ্য দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ
শনাক্ত হওয়ার পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলে গণফোরামের উভয় পক্ষের রাজনৈতিক
তৎপরতাও স্থবির হয়ে পড়ে।
0 Comments