।। এস এম মনিরুল ইসলাম মনি ।।
পাবনা-৪
এর শূন্য আসনের উপনির্বাচনকে ঘিরে জমে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের
প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। করোনা পরিস্থিতিতে গণজমায়েত নিষিদ্ধ তাই
অনলাইনে নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন নেতাকর্মী ও
সমর্থকরা।
গত ২রা এপ্রিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এমপি অসুস্থতা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু জনিত কারণে এই আসনটি
শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান অনুযায়ী কোনো আসন শূন্য ঘোষণা ৯০
দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে
দৈব-দুর্বিপাকের বিশেষ আইনে আরো ৯০ দিন সময় বৃদ্ধি করা হয়। সে অনুযায়ী
আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ হচ্ছে সেই সময়। তবে কবে হচ্ছে নির্বাচন এমন
জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগস্টের শেষের দিকে তফসিল ঘোষণা হবে বলে
জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের এমন ঘোষনার পরেই মুলত জমে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমর্থকদের প্রচার প্রচারণা।
একটি
সুত্রের মাধ্যমে জানা গেছে প্রয়াত সাংসদ ডিলুর পরিবার থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন
৫ জন, তবে শেষ পর্যন্ত ২ জন দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন এমনটিই শোনা
যাচ্ছে পারিবারিক সূত্রে। এই পরিবারের সম্ভাব্য প্রার্থী হচ্ছেন ডিলুর
স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ ও পুত্র গালিবুর রহমান শরীফ গালিব। দশম সংসদে
প্রয়াত সাংসদ ডিলু ভূমি মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে পরিবারের সদস্যদের
মধ্যে কোন্দল উশৃংখলতার কারণে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটেছে
ঈশ্বরদীতে। এছাড়া সাবেক এই মন্ত্রীর আরেক পুত্র উপজেলা যুবলীগের সভাপতি
শিরহান শরিফ তমাল এর হাতে রুপপুর আনবিক প্রকল্প এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর
আগমনের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়। দেশ
বিদেশের গণমাধ্যমে সে সংবাদ ফলাও করে প্রচার হলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন খোদ
দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া নানাবিধ কারণে সাধারণ
ভোটারের কাছে এ পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
ডিলুর সন্তান বিদেশের মাটিতে উচ্চ শিক্ষিত গালিব ক্লিন ইমেজের হলেও রাজনীতিতে একেবারেই
নবীন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের
সদস্য পদ নিয়ে পিতার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন।
তিনি মূলত যুক্তরাজ্য প্রবাসী একজন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। পিতার শূন্য
আসনে তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।
এ
ছাড়াও সাবেক সাংসদ ডিলুর কন্যা মেহজাবিন শিরিন প্রিয়া ও জামাই পৌর মেয়র
আবুল কালাম আজাদ মিন্টু দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রিয়া
তার মা ও ভাইয়ের বিপক্ষে প্রার্থী হয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষনা
দিয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব। সম্প্রতি তিনি
সংবাদ সম্মেলন করে পিতার শূন্য আসনে প্রার্থী হয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত
করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এদিকে নির্বাচনে ব্যাপারেভনিজের অবস্থানে অনড় মিন্টু। তবে
শেষ অবধি ডিলুর পরিবারে পারিবারিক সমঝোতা না হলে মিন্টু দলীয় মনোনয়ন ফরম
জমা দিবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই
আসনে অন্যতম শক্ত প্রার্থীদের তালিকায় শীর্ষে আছেন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে
জাসদের মশাল প্রতীকে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা নাসির কে পরাজিত করে এমপি
হওয়া সাবেক এমপি পাঞ্জাব বিশ্বাস। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন
আলোচনার শীর্ষে। এলাকায় তার সততা ও জনপ্রিয়তার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে।
ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করে তৃনমুল থেকে উঠে আসা সাবেক এই
সাংসদ জাসদের রাজনীতিতে ভাঙ্গন শুরু হলে ২০০২ সালে তৎকালীন বিরোধী দলে থাকা
আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মীসহ আওয়ামীলীগে যোগদান
করেন। বর্তমানে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন
করছেন। মেধাবী ও জনপ্রিয় কবি পাঞ্জাব বিশ্বাসের অর্থনৈতিক ভিত্তি ততটা মজবুত
না হলেও বিপুল পরিমাণ জনমত ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এই নেতার ঝুড়িতে। সাধারণ জনগণ টাকা দিয়ে তার নির্বাচন করে দেয়ার ইতিহাস আছে রাজনৈতিক সুবক্তা হিসেবে গোটা উত্তরবঙ্গে তার সুখ্যাতি রয়েছে। কর্মজীবনে
বর্তমানে তিনি তার নিজ গ্রামের বাড়িতে বিশ্বাস ইনকর্পোরেশন নামে একটি
এগ্রো প্রসেসিং মিল স্থাপন করে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। সততা
ও জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি
আসনটিতে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করতে পারবেন বলে মনে করেন পাবনা-৪ আসনের সাধারণ ভোটাররা।
এই
আসনের আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী ডিজিএফআই এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল
(অবঃ) নজরুল ইসলাম রবি। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৫ সালে সরকারি চাকরি
থেকে অবসর নেন। এরপর ধর্মীয় সামাজিক কাজে মনোযোগী হোন। চাকুরীরত অবস্থায়
১৯৯৪ সালে টাঙ্গাইলের নকশাবন্দী মুজাদ্দেদীয়া তরীকার খেলাফত প্রাপ্ত হন
এবং পরে আটঘরিয়ার বেরুয়ান গ্রামে তার গ্রামের বাড়িতে একটি খানকা
প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত খানকায় প্রতিমাসে নিয়মিত ধর্মীয় মাহফিল হয়।
মুজাদ্দেদিয়া ফাউন্ডেশন নামে তিনি একটি সামাজিক সংগঠন পরিচালনা করে আসছেন।
বর্তমানে তিনি মঈজুদ্দিন টেক্সটাইল গ্রুপ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব
পালন করছেন। সেনাবাহিনীর চাকরিতে থাকায় তিনি সরাসরি কখনো রাজনীতিতে জড়িত
ছিলেন না। একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামেন। এবারের
উপ-নির্বাচনেও তিনি দলীয় প্রতীক নৌকা পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে
নিশ্চিত করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি ছিলেন
আলোচনায় রাজনীতিতে অল্প দিন হলেও তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তার ছোট
ভাই মোঃ আমিরুল ইসলাম রাঙ্গা পাবনা জেলা জাসদের সভাপতি ও অন্যান্য ভাইয়েরা
স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। সরকারের সাবেক আমলা হওয়ার সুবাদে পরিচিতি
থাকায় তিনিও মনোনয়ন বাগিয়ে আনতে পারেন বলে অনেকের ধারনা।
এই
আসনের আরেক আলোচিত প্রার্থী সাবেক ছাত্রনেতা সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী রবিউল
আলম বুদু একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। করোনা কালীন সময়ে এলাকায়
ত্রাণ বিতরণ ও গণসংযোগ করে তিনিও নিজের প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকায় তারও মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা
রয়েছে।
আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম রতনের এই
উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা গেলেও তিনি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে
নিজের প্রার্থীতা ঘোষনা করেন নি। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার পুত্র
তানভীর ইসলাম আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান
নির্বাচিত হন। আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ায়ামীলীগের সভাপতি হওয়ার সুবাদে নিজ
উপজেলায় তার শক্ত অবস্থান থাকলেও ঈশ্বরদীতে তার অবস্থান ততটা শক্ত নয় এবং
পৌর মেয়র পদে থাকায় তার নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন অনেকেই।
এছাড়া
ডুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মৎস্যজীবী লীগের কেন্দ্রীয়
যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল আলীম, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবকলীগ
নেতা রফিকুল ইসলাম লিটন, ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস,
ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নায়েব আলী বিশ্বাস, সাবেক
ছাত্রনেতা সৈয়দ আলী জিরু, এদের নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই বলেই
মনে করেন স্থানীয়রা।
দেশের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রূপপুর আণবিক প্রকল্প পাবনা-৪ আসনের ভৌগোলিক
সীমায় হওয়ায় এই আসনের গুরুত্ব এখন অনেক। প্রায় ডজন খানেক প্রার্থী
থাকলেও সাধারণ জনগনের মাঝে আলোচনায় আছেন মাত্র তিন থেকে চারজন। ইতিমধ্যে
প্রার্থীরা মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে তদবির শুরু করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজ দলের নেতা কর্মীদের কর্মকান্ডে অনেকটাই বিব্রত দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আসনের সাধারণ ভোটারদের চাওয়া এমন ব্যক্তিকে
যেন মনোনয়ন দেওয়া হয় যার হাত ধরে পাবনা-৪ আসন একটি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ
এলাকায় পরিণত হবে ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। দলের সাধারণ কর্মী ও
সমর্থকদের দাবী মেধাবী ও দুর্নীতিমুক্ত সৎজন ব্যক্তিকেই তাদের এমপি হিসেবে
চায় এই আসনের সাধারণ জনগণ। দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা এই আসনে যোগ্য
প্রার্থী দিবেন বলেই মনে করেন এই আসনের ভোটাররা।
কে
হচ্ছেন এই আসনের চুড়ান্ত প্রার্থী? কার ঘরে যাচ্ছে সোনার হরিণ নৌকা? তা
জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরো ৪-৫ সপ্তাহ। নির্বাচন কমিশন তফশীল ঘোষনার পরেই
মুলত মনোনয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ।
0 Comments