বিজ্ঞাপন

শিরোনাম

6/recent/ticker-posts-pabnatimes

১লা বৈশাখ বনাম তথা কথিত পান্তা ইলিশ !


||মুরাদ মালিথা||
১লা বৈশাখ বাংলা নব বর্ষের প্রথম দিন। আমাদের বাঙালী জীবনের এক অনন্য সাধারণ দিন, এই দিন আমরা আমাদের হাজার বছরের লোকজ ঐতিহ্যের সাথে একাকার হওয়ার চেষ্টা করি , এদিন নিজেকে একজন বাঙ্গালী ভাবতে গর্ব বোধহয়। 

কিন্তু আমরা আমাদের হাজারো লোকজ সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে পান্তা ইলিশের নামে এক ঊদ্ভট অপসংস্কৃতি আমাদের বাঙালীপনাকে দখল করে নিতে বসেছে । 

কিন্তু পান্তা- ইলিশ আমাদের কোন, সংস্কৃতি থেকে এসেছে এর আদি অন্ত আমি তো খুজে পায়নি । শুধু এই টুকো জানা যায় ১৯৮০/৮১ সালের দিকে কোন কবি শুধু মাত্র ব্যবসার মানুষিকতা নিয়ে ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে পান্তা আর ইলিশের দোকান খুলে বসেন। তার পর হুজুগে বাঙালী !! কিন্তু আমাদের এক ঐতিহ্যে পান্তা-ভাত , লবণ, পেঁয়েজ,  কাঁচা মরিচ,বেগুন ভর্তা দিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু বাঙালীরা ভাতের অভাবে অথবা শখ করে এই পান্তা খেত না, এক ধরণের বিপদে পড়েই বাধ্য হয়েই বাংলার কৃষকরা পান্তা খেত। 

আমি একজন গৃহস্থ (কৃষক)বাড়ির সন্তান, আমি ছোট বেলায় নিজে দেখেছি , আর বাপ দাদার মুখ থেকেও শুনেছি ,তা হল  চৈত্র মাস জুড়ে কৃষকরা মাঠ থেকে হরেক রকম চৈতালী কেটে এনে প্রখর রোদে গরু দিয়ে মাড়াই করে করে ওগুলো বড় বড় গাদা করে রাখত। আর তখন এখনকার মত মাড়াই করার কোন মেশিন ছিল না। কাজেই ওগুলো বাতাসেই উড়াতে হত। এদিকে চৈত্র বৈশাখের প্রচন্ড রোদে খোলা আকাশের ওগুলো পরিষ্কার করা সম্ভব ছিল না। 

তাই খুব ভোরে অথবা জোছনা রাতের বাতাসে তারা মাড়াই করা চৈতালী পরিষ্কার করতো।  আর এগুলো বেশির ভাগ গৃহস্ত বাড়ীর মেয়েরাই করতো।আর পুরুষরা লাঙ্গল গরু নিয়ে খুব ভোরে মাঠে ছুটতো ,কারণ জো- আসা জমিতে যত তাড়াতাড়ি ধান পাট বোনা যায়। তাই কৃষানীরা বৈশাখী সময়ে গরম ভাত রেঁধে রঙ্গিন গামছায় বেধে কৃষকদের জন্য মাঠে নিতে পারতনা, সেকারনে এসময় কৃষানীরা সাজ রাতেই বেশী করে ভাত রেঁধে কিছু ভাতে পানি দিয়ে রাখতো সকালের জন্য। কিন্তু এই পান্তা ভাত তারা মরিচ পেঁয়াজ লবন দিয়েই খেত ,পান্তার সাথে ইলিশ কৃষকরা তো চোখেই দেখেনি। আর চৈত্র- বৈশাখ তো ইলিশের মৌসুম না। গ্রামের হাটে বাজারে এ সময় ইলিশ পাওয়া যেতই না। কালে ভদ্রে কোন কৃষক দু একটা ইলিশ কিনলেও বেগুন,পটল দিয়ে রান্না করে গরম ভাতের সাথেই খেয়ে নিত। চৈত্র বৈশাখে কৃষানীরা বাড়ীর আসপাশের কলমি, কচু ,খুড়ে সহ হরেক রকম সাক তুলে এনে রান্না করতো। আর এসময় এলাকার খাল বিলের পানি শুকিয়ে যেত, সেখানে প্রচুর টেংরা,পুটি, কৈ,শিং, মাগুর,শোল,টাকি ইত্যাদী মাছ পাওয়া যেত। গ্রামের কৃষকরা এগুলোই খেত। আর এসময় গ্রামের মানুষ কাঁচা আমের খাটা(টক) খেতে পছন্দ করতো। 

এবার দেখে নেওয়া যাক কয়েকজন সেরা বাঙালীর পছন্দের খাবার। হাজার বছরের সেরা বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের পছন্দের খাবার ছিল, গরম ভাতের সাথে ইলিশ মাছের মাথা। মাগুর ও কৈ মাছও তিনি বেশ পছন্দ করতেন। বাংলার অবিসাংবাদিত বাঙ্গালী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খাবার হিসাবে পছন্দের তালিকায় ছিল রুই মাছের মালাইকারী, টাকি মাছের ভর্তা, ইঁচর নামক এক ধরনের  কাঁচা কাঁঠালের  তরকারি। 
বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল পছন্দ  করতেন, পোস্ত দিয়ে বড় কৈ মাছ রান্না । শের এ বাংলা এ,কে ফজলুল হক সাহেবর প্রিয় খাবার ছিল ভুনা খিচরি (হক দানা ) গরুর মাংশ । মৌলানা ভাসানী সরিষার তেল,কাঁচা মরিচ, ও পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি খেতে পছন্দ করতেন। আর বাউল সম্রাট লালন শাইজি ইলিশ মাছ  পছন্দ করলেও তার আরেকটি প্রিয় খাবার ছিল দুধ আর খই, প্রায় প্রতি রাতেই তিনি দুধ আর খই খেয়েই ঘুমাতেন। উনাদের খাবারের মেনুতেও কোথাও পান্তা ইলিশ নেই। তা হলে, বাঙ্গালীপনার নামে ১লা বৈশাখ এই পান্তা ইলিশ কেন ? 

বৈশাখ মাস থেকেই তো ইলিশ মাছর প্রজনন মৌসুম, আর কিছুদিন পরেই মা ইলিশ লক্ষ লক্ষ রেনু ( জাটকার )জন্ম দিবে, এই  সময় বাঙ্গালীপনার ঐতিহ্যের নামে তথকথিত পান্তা ইলিশের অবাঞ্চিত রশনা বিলাসে এই সময় মা ইলিশ অকাতরে ধরা শুধু নৈতিকতা বিরোধীই না একটা মস্তবড় অপরাধও বটে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ও দায়িত্বশীলদের কি এখনো চুপ করে থাকা উচিত ।।

লেখকঃ (সাবেক ভি,পি, প্রগতিশীল কৃষক, কবি ও কলামিষ্ট )

Post a Comment

0 Comments