|| কামরুজ্জামান বিশ্বাস জিপু ||
সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ তার নিজ প্রয়োজনে ইতিহাস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আপন করে নিয়েছে। আর এ আপন করে নেওয়ার পথ ধরে সংস্কৃতির বিকাশ। প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় তার নিজস্ব অনুভূতি এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশি ও বাঙালী জাতি হিসেবে, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের এমন একটি উৎসব হলো বাংলা বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখ।
এবার আসা যাক বাংলা নববর্ষ কিভাবে আমাদের হলো, আমাদের দেশে প্রচলিত বাংলা সন মূলত ইসলামী হিজরী সনেরই একটি রূপ। ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছর, সৌর বছরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার এ হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
মোগল সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্রমাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং কিছু আনন্দ উৎসব করা হতো। এছাড়া বাংলার সকল ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি মূলত: রাষ্ট্রিয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন নিয়ম-কানুনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে কাজ-কর্ম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ছিল।
অথচ এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার চেষ্টা করেছে বৈশাখের ঐতিহ্যকে রুখে দিতে, তারা ইতিহাসকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, তারা “হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি” বলে প্রচার করেছে।
ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি কেবল মুসলমানই ছিলেন না বরং সারা মুসলিম বিশ্বে উদারপন্থি শাসক হিসেবে আজও পরিচিত, জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর।
পাকিস্তান সরকারের অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই “ছায়ানট” ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই “পহেলা বৈশাখ” বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপ ধারণ করে। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) ‘পহেলা বৈশাখ’ বাংলাদেশের জাতীয় পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১এ ফেব্রুয়ারির মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন।
এবার আসা যাক মঙ্গল শোভাযাত্রা;
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ৩০ বছর পূর্তি হবে এ বছর। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। তারপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়।
শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। ইতোমধ্যে ২০১৬ সালে এটি ইউনেসকো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতি দেয়ার সময় ইউনেসকো যেসব কারণের উল্লেখ করেছিল তার মধ্যে ছিল- এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
এ বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’।
আয়োজকরা বলছেন, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকবে মহিষ, পাখি ও ছানা, হাতি, মাছ, বক, জাল ও জেলে, ট্যাপা পুতুল, মা ও শিশু এবং গরুর আটটি শিল্পকাঠামো। এ ছাড়াও রয়েছে পেইন্টিং, মাটির তৈরি সরা, মুখোশ, রাজা-রানির মুখোশ, সূর্য, ভট, লকেট ইত্যাদি।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, আগে বৈশাখের অনুষ্ঠানের চেয়ে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান ছিল আকর্ষণীয়। এখনও চৈত্রের শেষ দিনে গাঁয়ের বধূরা বাড়ি ঘর পরিষ্কার করে। পুরানো বছরের সকল জরা গ্লানির গুচিয়ে নতুন করে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। আমরাও বরণ করতে চলেছি বাংলা ১৪২৬ কে। ১৪২৫ এর সকল অশুভকে পেছনে ফেলে সকলের জীবন হোক সত্য ও সুন্দর।
লেখকঃ (ছাত্রনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব)
0 Comments